কাশ্মির সমস্যার শেষ কোথায়?

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর রাজ্যটি পাকিস্তানের ভাগে পড়বে বলেই জিন্নাহ প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। বিষয়টি অমীমাংসিত থাকায় প্রিন্সলি স্টেটটি সে সময় থেকে অদ্যাবধি একটি স্পর্শকাতর স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সে সময়ে কাশ্মীরের ৮০ ভাগ লোক মুসলমান হওয়ায় নীতিগতভাবে কাশ্মীর পাকিস্তানের প্রাপ্য হওয়া সত্ত্বেও লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও নেহরু তা হতে দেননি। রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে নেহরু চেয়েছিলেন কাশ্মীরকে ভারতের ভেতর রাখতে। তাছাড়া রাজ্যটিতে তার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার কারণও ছিল। এ অবস্থায় কাশ্মীরকে নিজ নিজ দেশের অন্তর্ভুক্ত করাতে জিন্নাহ ও নেহরু উভয়েই ব্যর্থ হলে কাশ্মীর কৌশলগতভাবে ১৫ আগস্ট স্বাধীন হয়ে গেল এবং কাশ্মীরের হিন্দু রাজা অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় সেখানে অব্যাহতভাবে গোলমাল চলতে থাকল। ফলে কাশ্মীরের গোলমেলে স্বাধীনতার বয়স ছিল মাত্র ৭৩ দিন। রাজা হরি সিংয়ের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে ৩০০০ পাঠান উপজাতি ঝিলম নদী পেরিয়ে কাশ্মীরে ঢুকে পড়ল। পাকিস্তান যুক্তি দেখাল কাশ্মীরি জনগণ অত্যাচারী রাজা হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পাঠান উপজাতিদের ডেকে নিয়েছে। এ অবস্থায় পাঠান উপজাতিরা শ্রীনগরের কাছে এসে পৌঁছলে হরি সিং আতঙ্কিত হয়ে দিল্লির কাছে সামরিক সাহায্যের প্রার্থনা জানান এবং ২৪ অক্টোবর পরিবার ও সঙ্গীদের নিয়ে শ্রীনগর থেকে পালিয়ে শীতকালীন রাজপ্রাসাদে গিয়ে ওঠেন। এ ঘটনাকে পাকিস্তানি আক্রমণ আখ্যা দিয়ে নেহরু ও মাউন্টব্যাটেন কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্য পাঠালে ৩৫০০০ ভারতীয় সৈন্য এসে সেখানকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। কিন্তু হরি সিংয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো চুক্তি না থাকায় বিরোধ লেগেই থাকল। হরি সিং আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করলেন না। ভারত কাশ্মীরে সমাসীন হওয়ার পর নেহরুর বন্ধু শেখ আবদুল্লাহকে রাজ্যের প্রশাসনিক সরকারের প্রধান হিসেবে বসিয়ে দেয়া হলে হরি সিং কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ পরিত্যাগ করে কাশ্মীর থেকে নির্বাসিত হলেন। অতঃপর ১৯৪৯ সালে শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তার দল ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাধ্যমে কাশ্মীর শাসন করতে থাকলেন।
হরি সিং ছিলেন একজন হিন্দু শাসক, যিনি মুসলিম অধ্যুষিত একটি রাজ্য শাসন করে আসছিলেন। তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের ইচ্ছার কোনো মিল ছিল না। ফলে সহজেই কাশ্মীর তার হাতছাড়া হয়ে যায়। ঘটনার এ পর্যায়ে নেহরু ও মাউন্টব্যাটেন একমত হলেন যে, ‘কাশ্মীরের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য জনগণের রেফারেন্ডাম নিতে হবে।’ তদনুযায়ী ১৯৪৯ সালের ২ নভেম্বর নেহরু অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে বেতার ভাষণে বললেন, ‘যখনই শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে, তখনই আমরা রেফারেন্ডাম দিতে প্রস্তুত।’ নেহরু তার এই সিদ্ধান্ত একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকেও জানিয়ে বললেন, ‘আমরা ইউনাইটেড নেশন্সের মাধ্যমে যে কোনো রেফারেন্ডাম করাতে সম্মত আছি।’ কিন্তু শান্তি এলো না। কাশ্মীরে লড়াই শুরু হয়ে গেল এবং ইউনাইটেড নেশন্সের যুদ্ধবিরতি বলবৎ না হওয়া পর্যন্ত কাশ্মীরে লড়াই চলতেই থাকল। অবশেষে যুদ্ধবিরতির ফলস্বরূপ কাশ্মীরের এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হল, আর তার নাম দেয়া হল ‘আজাদ কাশ্মীর’, ভারতের কাছে যা ‘অধিকৃত কাশ্মীর’। কাশ্মীরের দুই-তৃতীয়াংশ থেকে গেল ভারতের নিয়ন্ত্রণে যা জম্মু ও কাশ্মীর নামে পরিচিত। এ ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত নেহরু প্রতিশ্র“ত রেফারেন্ডাম কখনোই অনুষ্ঠিত হয়নি, আর হবে বলেও মনে হয় না। ফলে আজও সেখানে শোকাবহ ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটছে না। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের লড়াই, ঝগড়া, শত্র“তা এখনও চলমান রয়েছে।
উল্লেখ্য, নেহরু কাশ্মীরকে কখনও হাতছাড়া করতে চাননি, কারণ নেহরুর পরিবারের জন্য কাশ্মীর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারটির উৎস্য কাশ্মীর। কাশ্মীর ছিল তাদের প্রথম ও শেষ আবেগ। যদিও তাদের পূর্বপুরুষরা কয়েক পুরুষ আগে কাশ্মীর থেকে সমতল ভূমিতে আসেন। তাই সে অর্থে নেহরু কিংবা ইন্দিরা কেউই বলতে পারেন না তারা কাশ্মীরি। তারপরও দেশভাগের ফলে নেহরু আর ইন্দিরার জীবনে কাশ্মীর একটি স্বতন্ত্র অনুষঙ্গ হয়ে ওঠায় ১৯৪৭-এর পর কাশ্মীরের কষ্ট, বিপদ ও রাজনৈতিক দুঃশাসনের ক্ষত সারাতে অস্বীকার করা হয়। ফলে কাশ্মীর একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতোই রয়ে যায়। সেই কাশ্মীরই ছিল আমার অদেখা। পৃথিবীর অনেক দেশ, অনেক সুন্দর এলাকা ভ্রমণের সৌভাগ্য হলেও কাশ্মীর দেখার সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এদিকে বয়সের কথা চিন্তা করে বিদেশ ভ্রমণের সংখ্যাও কমিয়ে দিয়েছি। এবারে তাই দিল্লি যাওয়ার বাধ্যবাধকতায় একইসঙ্গে কাশ্মীর ভ্রমণেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর তিন রাত, চার দিনের সেই ভ্রমণে যা দেখলাম, শুনলাম, জানলাম তার সংক্ষিপ্তসার না বলে পারছি না:
আমাদের ভ্রমণটি ছিল শ্রীনগরকেন্দ্রিক। সেখান থেকে গুলমার্গ, মন্ডেলাসহ কয়েকটি স্থান ভ্রমণ করেছি। প্রথমদিনেই ছিল শ্রীনগরের বিখ্যাত ডাল লেক ভ্রমণ, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘শাকারা’। একটি গয়নার নৌকায় একজন মাঝির বৈঠার চালনায় ডাল লেক ভ্রমণের নামই হল ‘শিকারা’। ডাল লেকের একদিকে রাস্তা, হোটেল, দোকানপাট, বাড়িঘর; আরেক দিকে পাহাড় আর অন্য দু’দিকে জলাধার। আমরা নৌকায় উঠে বসলে মাঝি বৈঠা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাসমান দোকানিরা এসে আমাদের নৌকাটিকে ঘিরে ধরায় আমি প্রথমে একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম এবং একটু চড়া সুরেই বললাম, ‘What is this?’ একটি নৌকা থেকে বলা হল ফটো উঠাব কিনা, একটিতে গহনা বিক্রি, একটিতে ফল বিক্রি ইত্যাদির ভাসমান দোকান। আমরা কাটা ফলের একটি প্যাকেট নিয়ে তাদের সবাইকে কোনোমতে বিদায় করলাম। যদিও আরও অনেক ভাসমান ফেরিওয়ালা নৌকায় এসে আমাদের এটাসেটা কেনার জন্য বিরক্ত করতেই থাকল। আমরাও ‘না’ ‘না’ বলে তাদের বিদায় করলাম। তারপরও ডাল লেক ভ্রমণের এখানে-সেখানে আমাদের নৌকার মাঝি বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী দেখাতে লেকের ধারের বিভিন্ন দোকানে নিয়ে গেলেন। লেকের পার্শ্ববর্তী স্থলভাগের সেসব দোকানে পশমিদ্রব্য, শাড়ি, থ্রি-পিস সবই দেখা গেল। আমরা দু-একটি দোকানে নেমে কিছু জিনিসপত্র দেখলেও তা পছন্দ না হওয়ায় কেনা হল না। পরে ঘুরতে ঘুরতে মাঝি একটু দূরের একটি স্থানে নিয়ে বললেন, এটার নাম ‘মীনাবাজার’। দেখলাম একই ধরনের দোকানে একটু জমকালোভাবে সাজানো একই ধরনের মালামাল। আমরা নামতে উৎসাহী না হয়ে নৌকা থেকে ওঠানামায় অসুবিধার কথা বলে আর কোনো দোকানেই নামলাম না। শেষ পর্যন্ত মাঝিও দোকান দেখানোয় ক্ষান্ত দিয়ে ভাসমান বোটহাউসগুলোয় কবে কোন সিনেমার শুটিং হয়েছিল সেসব বলতে থাকলেন। এভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ডাল লেক ভ্রমণে গুরুত্বপূর্ণ যা দেখলাম তা হল, ‘ডাল লেকের বোটহাউস’। শত শত বোটহাউস যেন পর্যটকদের ডেকে বলছে, ‘এসো হে সখা, এসো মোর হৃদয় কুটিরে’! কিন্তু একে তো সেখানে উত্তেজনাকর পরিবেশ, তার ওপর শীতকাল বিধায় সেখানে পর্যটক নেই বললেই চলে। তাই ডাল লেকের বোটহাউসগুলোও হৃদয়শূন্য করে বসে আছে। মনে হল ‘উদাস নয়নে তারা যেন প্রেমাস্পদের পথ চেয়ে আছে।’ শত শত বোটহাউস খালি পড়ে আছে। আর বেকার হয়ে বসে আছে সেসবের কর্মচারীরা। জানা গেল বসন্তে বোটহাউসগুলো প্রাণ ফিরে পাবে। অনেক পর্যটকই রাতযাপন করতে বেছে নেবেন এসব বোটহাউস। আবার অনেক নবপরিণীতা দম্পত্তি হানিমুনে এসে চেপে বসবেন এসব বোটহাউসে। উল্লেখ্য, এই ডাল লেকে বসবাসের সময় একে কেন্দ্র করেই আমীর খসরু মন্তব্য করেছিলেন, ‘গার ফিরদাউস রুহি জামিন অস্ত, হামিন অস্তো, হামিন অস্তো, হামিন অস্তো।’ অর্থাৎ ‘পৃথিবীতে যদি কোথায়ও বেহেশত থেকে থাকে তাহলে তা এখানে, তা এখানে, তা এখানে।’ আর সেদিন থেকেই কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ বলা হয়ে থাকে। যদিও আমি ডাল লেকের সৌন্দর্যে ততটা মুগ্ধ হইনি। হতে পারে সুইজারল্যান্ডের ল্যুজানসহ অন্যান্য স্থান এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে আমি আরও বেশি ভালো ভালো সৌন্দর্য উপভোগ করেছি, সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখেছি, সে কারণে আমার কাছে ডাল লেক এত মনমুগ্ধকর মনে হয়নি। অথবা যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সে সময়ে আমীর খসরুর পক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা সম্ভব না হওয়ায় তুলনামূলক অন্যান্য সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান তার অদেখা থাকায় তার কাছে ডাল লেকই পৃথিবীর ভূস্বর্গ মনে হয়েছিল। যদিও সৌন্দর্যের তুলনামূলক এ ধারণাটি নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত।
তবে শ্রীনগর থেকে বেশ খানিকটা দূরে গুলমার্গ ও মন্ডেলা দেখে আমি কিন্তু মুগ্ধ হয়েছি। ফেব্রুয়ারির প্রথমাংশের শীতে যা দেখলাম তাও চিরকাল মনে থাকবে। সেখানে গিয়ে বরফের রাজ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। গুলমার্গ থেকে কেব্ল কারে চেপে আমরা স্বামী-স্ত্রী পাহাড়ের অনেক উপরে হিমশীতল বরফের দেশে চলে গিয়েছিলাম এবং সেখানে ঘণ্টাখানেক থেকে চা-কফি খেয়ে, ফটো তুলে বরফের রাজ্যে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবার কেব্ল কারে চেপে ফিরে এসেছিলাম। পরদিন শ্রীনগরে যেসব স্থান দর্শন করেছিলাম, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শালিমারবাগ এবং আওরঙ্গজেবের তৈরি একটি কেল্লা। শালিমারবাগ তৈরি করেছিলেন মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর, যা সম্পূর্ণ লাহোরের শালিমারবাগের আদলে তৈরি। তবে লাহোরের শালিমারবাগটি আরও বড়। আর সম্রাট আওরঙ্গজেব (আলমগীর) সেখানে সূফীবাদ চর্চার জন্য একটা কেল্লা তৈরি করেছিলেন, যেখানে সূফী সাধকগণ সূফীবাদ চর্চা করতেন এবং মাঝে মধ্যে সম্রাট আওরঙ্গজেব সেখানে আসতেন।
যে কাশ্মীর নিয়ে এতক্ষণ কথা হল, যে কাশ্মীর দেখে এলাম, কেমন আছে সেই কাশ্মীর? কেমন আছেন সেই কাশ্মীরের মানুষজন? মূলত সেই প্রশ্ন মাথায় নিয়েই আমার কাশ্মীর ভ্রমণ শেষ হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ৩৭০-এর মাধ্যমে বিশেষ স্বায়ত্তশাসন লাভেও যে কাশ্মীরিরা সন্তুষ্ট নন তা স্বচক্ষেই দেখে এলাম। প্রতি শুক্রবার মসজিদে মসজিদে খুতবার সময় কাশ্মীরিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন। আর মসজিদ থেকে বের হয়েই মিছিল, বিক্ষোভ ইত্যাদির মাধ্যমে সে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। এসব বিক্ষোভ মিছিলে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বাধা প্রদান করলে তাদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কাশ্মীরি জনগণ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। প্রায় প্রতি শুক্রবারই তারা হরতাল-ধর্মঘট আহ্বান করে তাদের দাবি জানিয়ে আসছেন। আবার একই দাবিতে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনও লড়াই, যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে ভারত সরকার তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে অযৌক্তিক বলে বাতিল করে দিচ্ছে, সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে তাদের দমন করে চলেছে। অথচ কাশ্মীরি জনগণ তাদের নিজস্ব আবাসভূমি গড়ে তুলতে স্বাধীন কাশ্মীর চান। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষের যোদ্ধা বলে দাবি করেন। কাশ্মীরের রাস্তাঘাটে চলে-ফিরে, তাদের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি তা হল, আজ পর্যন্ত তারা নিজেদের ভারতীয় মনে করেন না। একটি আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা চান। এ নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তোষ বিদ্যমান। শ্রীনগরের মানুষের ৯৯ ভাগ মুসলমান।
একটি দোকানে কিছু পণ্য কিনতে গেলে আমারই বয়সী দোকান মালিক যখন জানলেন যে, আমি বাংলাদেশি; তখন বললেন, ‘বাংলাদেশ আপনাদেশ’। অর্থাৎ বাংলাদেশ তার নিজের দেশ। তিনি এ কথাও বললেন যে, তোমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ছিলে বলে স্বাধীনতা পেয়েছ। আমি ভয়ে কোনো জবাব দিলাম না। যদিও বলতে চেয়েছিলাম, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল, তারাও তো নিরন্তর যুদ্ধ করে চলেছেন এবং যুদ্ধের মধ্যেই আছেন। সেখানকার রাস্তাঘাটে দশ-বিশ গজ পরপর পুলিশ-মিলিটারি দিয়ে ঠাসা। যেখানে-সেখানে চেকপোস্টে নিরাপত্তা বাহিনী সমরসজ্জায় সজ্জিত এবং সব সময় যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দায়িত্বরত। অর্থাৎ সেখানকার পরিবেশে অনেকটাই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। কাশ্মীরে আজও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কাশ্মীর এখনও একটি অগ্নিকুণ্ড। আর তাই কাশ্মীর নিয়ে ভারত সরকারও শান্তিতে নেই। কারণ দেশবিভাগের সময়ই সেখানে যে অশান্তির বীজ রোপিত হয়েছিল, সেই অশান্তির সুরাহা করা হয়নি। জম্মু অংশে ধীরে ধীরে হিন্দু বসতি বাড়িয়ে সেখানকার পরিবেশে একটি ভারসাম্য আনার চেষ্টা করা হলেও শ্রীনগর অংশের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ অংশ আজাদ কাশ্মীর তথা পাকিস্তান সীমান্তবর্তী হওয়ায় সব সময়ই সেখানে যুদ্ধাবস্থা বিদ্যমান। সীমান্তে প্রায়ই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে।
কাশ্মীরের দখলদারিত্বের কথা অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে লিখতে হয় : ১৩২৪ খ্রি. জয়নুল আবেদীন এবং ইউসুফ শাহ চক কাশ্মীর শাসন করতেন। পরে ১৫৮৭ খ্রি. সম্রাট আকবর কাশ্মীর দখল করেন। তারপর ১৭৫২ খ্রি. আফগান শাসক মহম্মদ শাহ আবদালী কাশ্মীর দখল করেন। আবার ১৮১৯ খ্রি. পাঞ্জাবের শিখ শাসক মহারাজা রঞ্জিত সিং কাশ্মীর জয় করেন। অবশেষে ব্রিটিশরা কাশ্মীর দখল করে প্রিন্সলি স্টেটের মর্যাদায় তা শাসন করেন, যার সর্বশেষ রাজা ছিলেন হরি সিং। বর্তমানে কাশ্মীরের ৬০ ভাগ ভারত কর্তৃক শাসিত হচ্ছে। এভাবে সমগ্র কাশ্মীরের ২,২২,২৩৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে ৭৮,১১৪ বর্গকিলোমিটার পাকিস্তান কর্তৃক শাসিত হচ্ছে, যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত। চীনের অধীনেও কাশ্মীরের একটি বিশেষ অংশ রয়ে গেছে, যা অকঝঅও ঈঐওঘ নামে পরিচিত। পর্বতসংকুল এ এলাকাটি অবশ্য মনুষ্যবসবাসহীন। তাছাড়া পাকিস্তান কর্তৃক অধিকৃত অংশ থেকেও চীনের নিকট ৫,১৮০ বর্গকিলোমিটার জায়গা চীনকে ছেড়ে (ঈবফবফ) দেয়া হয়েছে। আর এভাবে কাশ্মীর বিভিন্নভাবে বিভক্ত হয়ে ৬০ ভাগ ভারতের, ৩০ ভাগ পাকিস্তানের এবং ১০ ভাগ চীনের অধীনস্থ হয়েছে। বর্তমানে ভারতের অধীনস্থ অংশকে শ্রীনগর, জম্মু ও লাদাখÑ এই তিনটি বিভাগে বিভক্ত করে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তন্মধ্যে শ্রীনগর ও লাদাখ অঞ্চল নিয়েই ভারতকে সব সময় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। কারণ এ অঞ্চলেই স্বাধীনতাকামীদের তৎপরতা বেশি। ভারত তাদের এ তৎপরতাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ হিসেবে আখ্যা দিলেও মুসলিম কাশ্মীরিদের কাছে তা স্বাধীনতা সংগ্রাম। কাশ্মীরি মুসলমানদের কেউই ভারতীয় হিসেবে থাকতে চান না। আর তাই তারা নিজেদের ইন্ডিয়ান ভাবেন না। শুধু সেনাবাহিনী দিয়েই এলাকাটিকে ভারত বানিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যথায় কাশ্মীরিরা বলেন, তারা স্বতন্ত্র জাতি। তাই তাদের দাবি হল, স্বতন্ত্র আবাসভূমি। যদিও বিগত ৭১ বছর ধরে তাদের সে দাবিকে পাত্তা না দিয়ে দমিয়ে রাখা হয়েছে; কিন্তু দেখেশুনে বা কথা বলে যা বোঝা গেল তা হল, বংশপরম্পরায় কাশ্মীরিরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি থেকে সরে আসবেন না। আর এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানও তাদের মদদ দিতেই থাকবে। কারণ এ ছাড়া পাকিস্তানেরও গতি নেই। কাশ্মীরিদের সাহায্য, সহযোগিতা, সমর্থন না দিয়ে পাকিস্তানে কোনো সরকারই টিকে থাকতে পারবে না। কারণ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সে ক্ষেত্রে সরকারকেই খেয়ে ফেলবে। তাই কাশ্মীর ইস্যু পাকিস্তানের জন্যও একটি প্রেস্টিজ ইস্যু। স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী নেহরু যে কথাটি পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে রেখেছিলেন এবং রেডিও ভাষণেও তিনি যা বলেছিলেন, সে কথা এখন বাস্তবায়নের সুযোগ আছে বলেও মনে হয় না। কারণ বহু আগেই ভারত সেখান থেকে সরে এসে স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে দমননীতির মাধ্যমে কাশ্মীর শাসন করে চলেছে। আর ভারত এখন বিরাট সামরিক শক্তির অধিকারী। তাই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কোন পথে হবে, কোন সময়ে হবে এখনই তা বলা যাচ্ছে না।
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Comments

Popular posts from this blog

কাশ্মির ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক